সালেহা খাতুন

সালেহা খাতুন

সালেহা খাতুন – একজন জীবনের কবি জীবনে এমন কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের পরিচয় শুধুমাত্র তাঁদের নামেই সীমাবদ্ধ থাকে না। তাঁদের জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি লড়াই, প্রতিটি নিঃশ্বাস—তাঁদের সত্তাকে পরিপূর্ণ করে তোলে। সালেহা খাতুন ঠিক তেমনই একজন মানুষ। তিনি শুধু একজন কবি নন; তিনি একজন মায়ের প্রতিচ্ছবি, একজন স্ত্রীর কণ্ঠ, একজন স্বপ্ন দেখা নারীর মূর্ত প্রতীক। সংসারের চেনা চক্রের মাঝে দাঁড়িয়ে যিনি হারাননি নিজের আত্মা, নিজের স্বর। শৈশব ও শুরুর দিনগুলো সালেহা খাতুনের জন্ম হয়েছিল এক মধ্যবিত্ত পরিবারে, যেখানে অভাব ছিল, কিন্তু ভালোবাসার কোনো ঘাটতি ছিল না। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। বৃষ্টি হলে জানালার পাশে বসে ভাবতেন—বৃষ্টির ফোঁটা কাঁদছে না হাসছে? স্কুলের খাতায় লিখতেন ছোট ছোট ছড়া, যা হয়তো সে সময় কেউ খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু তাঁর নিজের কাছে সেগুলো ছিল ধনভাণ্ডার। তিনি বড় হয়েছেন গ্রামীণ পরিবেশে, যেখানে প্রকৃতির ছোঁয়া মনের মধ্যে এক বিশেষ ধ্যান সৃষ্টি করেছিল। ভোরের কুয়াশা, দুপুরের মাঠ, সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে হারিয়ে যাওয়া পথ—সবই ছিল তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস। সংসার জীবনের শুরু কবিতা লেখার ভালোবাসা সঙ্গে নিয়েই তিনি প্রবেশ করেন সংসার জীবনে। কিন্তু বাস্তবতার চাপে কবিতার খাতা একসময় ধূলিময় হয়ে পড়ে। ঘর, সন্তান, দায়িত্ব, সীমাবদ্ধতা—সবকিছুর মাঝেই তিনি হারিয়ে ফেলেন নিজের ভাবনার সময়। কিন্তু হারিয়ে যাননি পুরোপুরি। তিনি বুঝেছিলেন—কবিতা শুধু কবিতার খাতায় লেখার জন্য নয়, কবিতা তাঁর ভেতরের কান্না, তাঁর না-পাওয়া, তাঁর ভালোবাসা—যা তিনি শব্দে সাজাতে চান, নিজের জন্য, আবার সবার জন্যও। তাঁর কবিতা লেখা শুরু হয় পুনরায়, সন্তানের স্কুলে যাবার পর, চা খেতে খেতে, একাকী দুপুরে। কোনো প্রত্যাশা ছিল না, শুধু নিজের মনে লেখা। কিন্তু সেই লেখাগুলো ধীরে ধীরে হয়ে উঠলো সংগ্রামের দলিল, নারীর মনস্তত্ত্বের নীরব কণ্ঠস্বর। কবিতা তাঁর কাছে কী? সালেহা খাতুন কবিতাকে কখনও অলংকার বা জটিলতার জালে জড়াতে চাননি। তাঁর কবিতা সহজ ভাষায় লেখা, কিন্তু তা হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে। তিনি বলেন— "আমি কবিতা লিখি কারণ আমার কিছু বলার আছে। আমি কাঁদি, আমি হাসি, আমি ভালোবাসি—এই তিনটাই আমার কবিতায় থাকে।" তিনি বিশ্বাস করেন, একজন কবির কাজ কেবল রূপকের পেছনে ছুটে যাওয়া নয়, বরং পাঠকের অনুভূতিকে স্পর্শ করা। বিষয়বস্তু ও কাব্যচেতনা সালেহা খাতুনের কবিতার প্রধান উপজীব্য হলো—নারীজীবনের বাস্তবতা, মায়া-মমতা, মাটির ঘ্রাণ, স্বপ্ন, প্রতিবাদ ও নিঃশব্দ বেদনা। তিনি লিখেছেন— - মাতৃত্ব ও নারীত্ব নিয়ে - প্রেমের গভীরতা ও বিচ্ছেদের বিষণ্ণতা নিয়ে - সমাজের অবহেলা ও নারীর আত্মজাগরণ নিয়ে - অসহায় মানুষের কষ্ট, যুদ্ধ, এবং সাম্প্রতিক সামাজিক সংকট নিয়ে (যেমন—গাজা বা ফিলিস্তিন সংকট) তাঁর কবিতায় বারবার উঠে এসেছে নিপীড়িত মানুষের গল্প। তিনি কখনও সরাসরি রাজনীতি করেননি, কিন্তু তাঁর কলম প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে বহুবার। স্বীকৃতি ও পাঠকের ভালোবাসা তিনি কোনো পুরস্কারের প্রত্যাশায় লেখেননি। তবে সময়ের সঙ্গে তাঁর কবিতাগুলো সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। একসময় পাঠকের ভালোবাসা তাঁকে সাহস জোগায় নিজের লেখা সংকলিত করে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে। তাঁর পাঠকেরা বলেন— "এই কবিতা আমার জীবনের কথা বলে।" "এটা যেন আমার না বলা অনুভূতি।" এই ভালোবাসাই তাঁকে করে তুলেছে একজন সত্যিকারের কবি। জীবনের শেষভাগে স্বপ্ন আজও তিনি কবিতা লেখেন, নতুন প্রজন্মের জন্য, নিজের আত্মার প্রশান্তির জন্য। তিনি চান, তাঁর কবিতাগুলো একদিন পাঠকের ঘরে থাকবে, ছোট্ট শিশুর মুখে মুখে ফিরবে, কারও কান্না থামাবে, কারও ভালোবাসা বাড়াবে।

সালেহা খাতুন-এর কবিতাসমূহ